চা মৌসুমী অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চভূমির ফসল। একপ্রকার চিরহরিৎ বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে চা প্রস্তুত করা হয়। চীন দেশে চায়ের আদি জন্মভূমি। বর্তমানে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পানীয়রূপে গণ্য করা হয় । ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে এর চাষ শুরু হয় ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চা-চাষ।
চায়ের প্রকারভেদ
পৃথিবীতে আসাম এবং চীনজাতীয় - এ দুই প্রকারের চা গাছ দেখতে পাওয়া যায়। তন্মধ্যে আসামজাতীয় চা গাছ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অধিক চাষ করা হয়। এ ধরনের গাছ বেশ বড় এবং বহু পাতাযুক্ত হয়। বিধায়, এটি বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ করার জন্যে বিশেষ উপযোগী। এ গাছ প্রায় ৬ মিটার বা ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। পাতার নাগাল পাওয়া এবং পাতা সংগ্রহের জন্য গাছগুলোকে ১.২ মিটার বা ৪ ফুটের অধিক বড় হতে দেয়া হয় না। ছেঁটে দেয়ার ফলে চা গাছগুলো ঘণঝোঁপে পরিণত হয়।
অন্যদিকে চীনজাতীয় গাছ আকারে বেশ ছোট হয়। এতে পাতার সংখ্যাও অনেক কম থাকে। এ গাছ না ছাঁটলেও পাতা তোলার মতো উচ্চতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।
দৈনন্দিন জীবনে স্বাস্থ্য সূরক্ষায় চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পুষ্টিগুণ সামান্য হলেও এতে রয়েছে কিছু মুল্যবান উপাদান যা শরিরে নানাবিধ উপকারে আসে। যেমন- পলিফেনলস, ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং ক্যাটেচিন। পলিফেনলস এবং ক্যাটেচিন ফ্রি রেডিক্যালস তৈরিতে বাধা দেয় এবং কোষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। একারণে চা ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চায়ে উপস্থিত পলিফেনলসের পরিমাণ ২৫% এরও বেশি যা দেহের অভ্যন্তরে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
বর্তমান আমরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আগের থেকে একটু হলেও বেশি মনোযোগ দিচ্ছি শরিরের দিকে। কারণটা তো সবারই জানা । করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার অল্প ক’টি উপায়ের মধ্যে চা এটিও একটি অন্যতম ঘোরোয়া পদ্ধতী
চায়ে ৭% Theophylline and Theobromine রয়েছে যা শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির জন্য অনেক উপকারী উপাদান হিসেবে কাজ করে। চা এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হলেও এতে রয়েছে Caffeine নামক উত্তেজক পদার্থ। সাধারণত এক কাপ চায়ে রয়েছে (৩০-৪০) মিলিগ্রাম Caffeine এবং এক কাপ কফিতে এর প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ (৮৫ মিলিগ্রাম) Caffeine রয়েছে। বস্তুত ক্যাফেইনের কারনেই ঘুম কম হওয়া,হজমে ব্যঘাত ঘটা ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তবে এই ক্যাফেইনের কিছু ভালো দিকও রয়েছে। এটি হৃদপিন্ড ও দেহের অন্যান্য পেশি সতেজ রাখতে সহায়তা করে।
প্রতিদিন সকালে এক কাপ চা না খেলে কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে শরীরটটা। তাই না? কিন্তু কি চা খান সকালে ? দুধ চা খেলে ক্ষণিকের জন্য মনটা চনমনে হয়ে উঠলেও শরীরের কিন্তু কোনও উপকারই হয় না। তবে যদি এক পেয়ালা লাল চা খান, তাহলে কথাই নেই! মনের পাশপাশি শরীরটাও চাঙ্গা থাকে সারাটাদিন। কারণ লাল চা-এর উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। এই পানীয়টি নানাভাবে শরীরের গঠনে কাজে লাগে, যে সম্পর্কে জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
লাল চায়ে বেশ কিছু উপাদান রয়েছে, যা শরীরে ক্লান্তি দূর করার পাশপাশি হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । লাল চায়ে থিয়োফিলাইন নামে একটি উপাদান থাকে। এটি শরীরকে সার্বিকবাবে চাঙ্গা করতে দারুন কাজে দেয়। এখানেই শেষ নয়। এই পানীয়র আরও কিছু উপকারিতা আছে। যেমন.
১. চায়ে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
প্রতিদিন কয়েক কাপ লাল চা আপনাকে এই রোগের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। আসলে এই পানীয়তে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট প্রপার্টিজ সহ এমন কিছু উপাদান, যা লাং, প্রস্টেট, কলোরেকটাল, ব্লাডার, ওরাল এবং ওভারিয়ান ক্যান্সারকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, লাল চা শরীরের যে কোনও অংশে ম্যালিগনেন্ট টিউমারের বৃদ্ধি আটকাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটে
নানাধরনের অসুস্থতা থেকে বাঁচতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটা একান্ত প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করতে পারে লাল চা। এই পানীয়তে টেনিস নামে একটি উপাদান রয়েছে, যা নানা ধরনের ক্ষতিকর ভাইরাসের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে। ফলে সহজে কোনও রোগ ছুঁতে পারে না।
৩. মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
লাল চায়ে ক্যাফিনের পরিমাণ কম থাকায় এই পানীয়টি মস্তিষ্কে রক্তচলাচলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে স্ট্রেস কমে। প্রসঙ্গত, একটি গবেষণায় দেখা গেছে এক মাস টানা যদি লাল চা খাওয়া যায়, তাহলে Parkinson এর মতো রোগ থেকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়।
আরও জানুন -
মধু খাওয়ার নিয়ম এবং মধুর অসাধারণ গুনাগুন
তুলসী পাতার উপকারিতা ও তুলসী পাতা খাওয়ার নিয়ম
লেবু খাওয়ার উপকারিতা ও লেবুর পুষ্টিগুন
গরম পানি খাওয়ার নিয়ম ও গরম পানির উপকারিতা
বৃষ্টির পানির উপকার ও ব্যবহারের নিয়ম
দাতের ব্যথায় করনীয় এবং ঘরোয়া টোটকামাইগ্রেন কি কেনো হয় এবং হলে করনীয় কি
৪. ওজন হ্রাস করে
লাল চা হজম ক্ষমতার উন্নতি করে । হজমের উন্নতি হওইয়ার ফলে শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমার সুযোগই পায় না। তাই আপনি যদি ওজন কমাতে চান , তাহলে আজ থেকেই খাওয়া শুরু করুন এই পানীয়।
৫. হার্ট চাঙ্গা হয়ে ওঠে
হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে করতে চাইলে লাল চায়ের কোনও বিকল্প নেই বললেই চলে। আসলে এই পানীয়তে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট প্রপাটিজ হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একেবারে কমিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত, স্ট্রোকের সম্ভাবনা কমাতেও লাল চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
আরও জানুন -
মধু খাওয়ার নিয়ম এবং মধুর অসাধারণ গুনাগুন
তুলসী পাতার উপকারিতা ও তুলসী পাতা খাওয়ার নিয়ম
লেবু খাওয়ার উপকারিতা ও লেবুর পুষ্টিগুন
গরম পানি খাওয়ার নিয়ম ও গরম পানির উপকারিতা
লাল চা খাওয়ার নিয়ম ও লাল চায়ের উপকারীতা
বৃষ্টির পানির উপকার ও ব্যবহারের নিয়ম
দাতের ব্যথায় করনীয় এবং ঘরোয়া টোটকামাইগ্রেন কি কেনো হয় এবং হলে করনীয় কি
৬. হাড়কে শক্তপোক্ত করে
লাল চায়ে থাকা Phytochemicals হাড়কে শক্ত করে। ফলে আর্থ্রাইটিসের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়।
৭. হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়
প্রতিদিন লাল চা খেলে হজম শক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। লাল চায়ে রয়েছে টেনিস নামে একটি উপাদান, যা হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটানোর পাশপাশি গ্য়াস্ট্রিক এবং নানা ধরনের ইন্টেস্টিনাল রোগ সারাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৮. স্ট্রেস কমায়
লাল চায়ে রয়েছে Amaino acid, যা চাপ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই সঙ্গে মনকে চনমনে করে তুলতেও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে এই চায়ে।
খালি পেটে চা খাওয়া নিয়ে অনেকেই অনেক রকম প্রশ্ন করেন ? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চান অনেকেই।
ইদানীং বলা হচ্ছে, ঘুম থেকে উঠে প্রথমে বেশি করে পানি খাওয়া উচিত ,পানিতে সামান্য লেবুর রস বা লবণ মিশিয়ে খেলে অনেক উপকার হয়। সকালে পানি খাওয়ার অভ্যাস করলে পেট পরিষ্কার হয়ে যাবে। পানি খাওয়ার পর সামান্য বাদাম বা ছোলা ভেজানো অথবা কোনো ফল খেতে পারেন। তাহলে সূষ্ঠভাবে মেটাবলিজম কাজ করতে আরম্ভ করে । এরপর আসবে চায়ের পালা। ব্রেকফাস্টের সঙ্গে চা খেলে কোনো অসুবিধা হয় না সাধারণত।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চিনি ছাড়া লাল চায়ের কাপে চুমুক দিলেই সারাদিনের এনার্জি পেয়ে যাবেন একবারেই। শরীর চাঙ্গা। কারণ, লাল চা-এ রয়েছে ক্যাফেইন, কার্বোহাইড্রেট, পটাশিয়াম, মিনারেল, ফ্লোরাইড, ম্যাঙ্গানিজ ও পলিফেনল। এ ছাড়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ট্যানিন, গুয়ানিন, এক্সাথিন, পিউরিনে ভরপুর লাল চা। তবে বেশি পরিমাণে নয়। প্রতিদিন মাত্র ৩ কাপ লাল চা। আর তাতেই অনেক উপকার পাবেন এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, দিনে একবার লাল চা খেলে গ্লুকোমার মতো চোখের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে প্রায় ৭৫ শতাংশ। গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হলে চোখের ভেতরে চাপ বাড়তে শুরু করে। ফলে, অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। লাল চায়ের সঙ্গে দৃষ্টিশক্তির ভালো-মন্দের সরাসরি যোগ আছে। কারণ, লাল চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি প্রপাটিজ এবং নিউরো প্রোটেকটিভ কেমিক্যাল চোখ ভালো রাখতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটঃ
চা গাছের জন্য অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত ও তাপের প্রয়োজন হয় বলে বাংলাদেশের বৃষ্টিবহুল পাহাড়িয়া অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চায়ের চাষ করা হয়। চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের চা উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন কেজি এবং এখান থেকে চা রফতানি করা হয় ২৫টি দেশে। চা উৎপাদনের দিক থেকে এগিয়ে আছে চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টমে। বাংলাদেশে চা পানকারীর সংখ্যা প্রতিবছর ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। চা পানে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৬তম ৷
বর্তমানে ৪৭,৭৮১ হেক্টর জমিতে ১৬৪টি চা বাগানের মধ্যে সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১৪৮টি চা বাগান। তন্মধ্যে ৯০% চা সিলেট বিভাগে এবং অবশিষ্ট ১০% চট্টগ্রাম বিভাগে উৎপন্ন হয়। প্রায় সকল চা বাগান ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত। তবে সাম্প্রতিককালে পঞ্চগড় জেলায় কিছু নতুন চা বাগান স্থাপিত হয়েছে। এক সময় বাংলাদেশ চা রপ্তানি করে অনেক আয় করত। কিন্তু বর্তমানে চা আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ চা বোর্ড এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ৮ কোটি ৮৯ লাখ কেজি চা ভোগ করা হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন ছিল এর থেকেও কম।
চা বাগানগুলোতে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। অস্থায়ীভাবে কাজ করছে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। বাংলাদেশ সরকারের সাথে ২০০৯ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে বাগানের শ্রেণীভেদে শ্রমিকেরা যথাক্রমে দৈনিক ৪৮.৪৬ টাকা ও ৪৫ টাকা হারে মজুরি পায়। স্থায়ী শ্রমিকদেরকে রেশন হিসেবে প্রতিদিন আধা-কেজি চাউল অথবা আটা দেওয়া হয়।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া, চেক ও স্লোভাক প্রজাতন্ত্র, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, জাপান, মিশর, সুদান, জর্ডান, গ্রীস, সাইপ্রাস, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে চা রপ্তানী করা হয়। বাংলাদেশের চা পৃথিবীব্যাপী '''সিলেট টি''' নামে খ্যাত।
বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার একটি চা বাগানে চা গাছ একুশ শতকে বাংলাদেশ অরগ্যানিক টী পঞ্চগড়ে চা উৎপাদন করা শুরু করেছে। এর উৎপাদক কাজী এন্ড কাজী। এছাড়াও, পঞ্চগড়ে ময়নাগুড়ি টি এস্টেট, কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট, টিটিসিএল চা বাগান রয়েছে।
ইতিহাস, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট এবং ছবি
0 Comments