জলপাই ফলটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় টক ফল। জলপাই ফলের বৈজ্ঞানিক নাম Elaeocarpus serratus। জলপাই ফলটি সিলন অলিভ (Ceylon olive) নামেও বেশ পরিচিত। জলপাই ফলটি উৎপাদিত হয় ভারতীয় উপমহাদেশ, ইন্দোচীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ।
অনেকেই জয়তুন-এর সাথে জলপাই ফলকে এক করে ফেলে, যদিও এ দুটি ফল সম্পূর্ণ আলাদা ।
জলপাই গাছের বর্ণনাঃ
জলপাই গাছ সাধারনত মাঝারি আকারের হয়ে থাকে , আবার ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বাও হতে পারে। জলপাই ফলের পাতা শীতকালে ঝরে পড়ে , ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের দিকে আবার নতুন পাতা আসে। এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা ফুল আসে।জলপাই গাছের ফুলের সৌন্দর্য অসাধারণ । জলপাই গাছের পুরো গাছ জুড়ে অসাধরন ফুলে সমারহ দেখা যায় , যা সত্যিই খুবই অসাধারন জলপায়ের ফলের সৌন্দর্য উপেক্ষা করা কঠিন। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সাদা রঙের থোকা থোকা ফুলগুলো ফুটে বেরাই। জলপাই ফলটি খাবার মতো উপযোগী হয়ে ওঠে শরৎ-হেমন্তে। এই সময় ফলের বাইরের আবরণ সবুজের কাছাকাছি একটি বিশেষ রঙ ধারণ করে। এ কারণে জলপাই রঙ সবার কাছে একটি বিশেষ রঙ হিসেবে পরিচিত। জলপাইয় ফলটি দেখতে অনেকটা আমড়ার মতো। তবে আমড়ার চেয়ে আকারে ছোট হয় এই ফলটি। ফলটির পাতলা আবরণের ভেতর থাকে খাবার উপযোগী শাঁস ও একটি শক্ত আঁটি বা বীজ।
কাঁচা ফলের শাঁস কিছুটা টক, যা ইঙ্গিত দেয় যে এটি ভিটামিন সি এর একটি ভাল উৎস। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ফল খনিজ, ভিটামিন, ফাইবার এবং মূল্যবান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ।
একটি জলপাই ফলের ওজন হয়ে থাকে ১৫.৭৮ থেকে ২২.৪৬ গ্রাম, দৈর্ঘ হয় ৪.০৭ থেকে ৪.৪৯ সে:মি:, ব্যাস হয় ২.৬২ থেকে ২.৮৯ সে:মি: হয়ে থাকে। ফলের রং গাঢ় সবুজ, ফলের মধ্যখানে থাকে বাদামী আটি বা বীজ , আটির চারপাশ থাকে টক-মিষ্টি স্বাদের শাঁস।
জলপাই ফলের পুষ্টিগুণ
প্রতি ১০০ গ্রাম জলপাই ফলে রয়েছেঃখাদ্যশক্তিঃ ৭০ কিলোক্যালরি,
শর্করাঃ ৯ দশমিক ৭ ,
ক্যালসিয়ামঃ ৫৯ মিলিগ্রাম ,
ভিটামিন-সিঃ ১৩ মিলিগ্রাম ।
জলাপাইয়ে রয়েছে নানান রকমের গুণ। মসৃণ আর সবুজ ভাবের চেহারার এই ফলটি খেতে টক হলেও এর গুণাগুণ আমাদের শরীরের জন্য বেশ কার্য্যকরি । আমাদের দেশে জলপায়ের আচার বেশ জনপ্রীয় এবং সুস্বাদু আচার। শুধু আচার খেলেই হবেনা কাচা বা রান্না করেও খেতে হবে জলপাই ফলটি । যা শরীরের নানান পুষ্টি যোগায় ।
জলাপাইয়ে রয়েছে নানান রকমের গুণ। মসৃণ আর সবুজ ভাবের চেহারার এই ফলটি খেতে টক হলেও এর গুণাগুণ আমাদের শরীরের জন্য বেশ কার্য্যকরি । আমাদের দেশে জলপায়ের আচার বেশ জনপ্রীয় এবং সুস্বাদু আচার। শুধু আচার খেলেই হবেনা কাচা বা রান্না করেও খেতে হবে জলপাই ফলটি । যা শরীরের নানান পুষ্টি যোগায় ।
চলুন জেনে নিই জলপাইয়ের গুণাগুণ-
১. জলপাইয়ের তেল যে কোনো বয়সের মানুষের জন্য অনেক উপকারী। জলপাই ও এর তেলে নেই কোনো চর্বি বা কোলেস্টেরল। তাই রক্তে চর্বি বা লিপিড জমে যাওয়ারও কোনো ভয় নেই। অন্যদিকে রক্তের চর্বি বা ফ্যাটের পরিমাণও কমায় এই জলপাই।
২. অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট জলপাইতে রয়েছে উচ্চহারে। এই উপাদানের জন্য দেহের রোগ-জীবাণুগুলো মারা যায় এবং অতিবেগুনি রশ্মি থেকেও ত্বক রক্ষা পায়।
২. অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট জলপাইতে রয়েছে উচ্চহারে। এই উপাদানের জন্য দেহের রোগ-জীবাণুগুলো মারা যায় এবং অতিবেগুনি রশ্মি থেকেও ত্বক রক্ষা পায়।
৩. জলপাইয়ের খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ বা ডায়াটারি ফাইবার, যা পাকস্থলীর বিভিন্ন অংশ যেমন ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র, কোলনের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এবং এই আঁশ খাবার সঠিকভাবে হজমে সহায়তা করে।
৪. দেহের রক্ত চলাচল ঠিক রাখতে অবদান রাখে। ফলে দেহের জন্য ক্ষতিকর লাইপোপ্রোটিনের পরিমাণ কমে যায়। হৃৎপিন্ড কাজ করে সঠিকভাবে।
৫. এতে আছে উচ্চমাত্রার ভিটামিন ‘সি’ ও ‘এ’। এই ভিটামিন দুটি চোখের বিভিন্ন রোগকে দূরে রাখতে সহায়তা করে। ত্বক, চুল, দাঁত, হাড়কে রাখে মজবুত।
৬. নিয়মিত জলপাই খেলে গলব্লাডার বা পিত্তথলিতে পাথর, বাতের ব্যথা কিংবা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের পরিমাণ কমে যায়।
৭. জলপাইয়ে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্টও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে, যা দেহের ক্যানসারের জীবাণুকে ধ্বংস করে এবং রোগ প্রতিরোধ শক্তিকে বাড়ায় দ্বিগুণ পরিমাণে।
৭. জলপাইয়ে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্টও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে, যা দেহের ক্যানসারের জীবাণুকে ধ্বংস করে এবং রোগ প্রতিরোধ শক্তিকে বাড়ায় দ্বিগুণ পরিমাণে।
৮. রাতকানা, চোখওঠা, চোখের পাতায় ইনফেকশন জনিত সমস্যাগুলো দূর করে এই জলপাই।
জলপাই এর উপকারিতা
জলপাই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে: জলপাই রয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট । এবং রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি । জলপাই ফল খেলে সর্দি, জ্বর এবং নানান রোগ থেকে দূরে রাখে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
জলপাই ফল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে: জলপাই শরীরের রক্তের চিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কার্যকরি ভূমিকা রাখে।
জলপাই এর ব্যবহার
জলপাই বাংলাদেশে একটি সুপরিচিত ফল। কাঁচা জলপাই বেশ পুষ্টিকর, প্রচুর ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। কাঁচা ফল টাটকা, রান্না করে ও আচার তৈরী করে খাওয়া হয়।
জলপাই আচারের জন্য দুর্দান্ত। কাঁচা ফলগুলি প্রথমে সেদ্ধ করা হয়। তারপর কড়াইতে তেল গরম করে তাতে বিভিন্ন মসলার মধ্যে ঢেলে দিয়ে পরে চিনি ও জল দিয়ে আবার কিছুক্ষণ রান্না করার পর ঠাণ্ডা করে পরিবেশন বা সংরক্ষণ করা হয়।
জলপাই সাধারণত ডালের সঙ্গে এবং আচার বানিয়ে খায় সবাই। কিন্তু কাঁচা জলপাইয়ের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। প্রতিদিন জলপাই খাওয়ার অভ্যাস করলে আপনার স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে।
জলপাইয়ের খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ। এই আঁশ নিয়মিত খাবার হজমে সাহায্য করে। পাশাপাশি পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত, বৃহদন্ত্র ও কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে এই ফল।
গবেষণায় দেখা গেছে, জলপাই এর তেল আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী।
জলপাইয়ের উপকারিতাঃ
হৃদ্যন্ত্রের যত্নে জলপাই ঃ
যখন কোনো মানুষের রক্তে ক্ষতিকর মুক্ত কণিকা (ফ্রি র্যা ডিকেল) ও কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায় তখন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি থাকে। জলপাইয়ের তেল হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। জলপাইয়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। ফলে কমে যায় হৃদ্রোগের ঝুঁকি।
ক্যানসার প্রতিরোধে জলপাইঃ
কালো জলপাই ভিটামিন-ই–এর বড় উৎস। যা ফ্রি র্যা ডিকেল ধ্বংস করে। ফলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। জলপাইয়ের ভিটামিন-ই কোষের অস্বাভাবিক গঠনে বাধা দেয়। ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।
ওজন কমাতে জলপাই ফলঃ
যখন জলপাইয়ের মোনো-স্যাচুরেটেড ফ্যাট অন্য খাবারে বিদ্যমান স্যাচুরেটেড ফ্যাটের বদলে গ্রহণ করা হয় তখন তা দেহের ভেতরের ফ্যাট সেলকে ভাঙতে সাহায্য করে। জলপাইয়ের তেলেও রয়েছে লো কোলেস্টেরল যা ওজন এবং ব্লাডপ্রেশার কমাতে সহায়ক।
পরিপাকক্রিয়ায় সাহায্য করেঃ
নিয়মিত জলপাই খেলে গ্যাস্ট্রিক ও আলসার কম হয়। বিপাকক্রিয়া ঠিকভাবে হয়।
লোহার ঘাটতি মেটায়ঃ
কালো জলপাই লৌহের বড় উৎস। রক্তের লোহিত কণিকা অক্সিজেন পরিবহন করে। কিন্তু শরীরে লৌহের অভাব হলে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। ফলে শরীর হয়ে পড়ে দুর্বল। লৌহ শরীরের এনজাইম চাঙা রাখে।
চোখের যত্নেঃ
জলপাইয়ে ভিটামিন-এ পাওয়া যায়। ভিটামিন-এ চোখের জন্য ভালো। যাদের চোখ আলো ও অন্ধকারে সংবেদনশীল তাদের জন্য ওষুধের কাজ করে জলপাই। এ ছাড়া জীবাণুর আক্রমণ, চোখ ওঠা, চোখের পাতায় ইনফেকশনজনিত সমস্যা দূর করে এটি।
পিত্তথলিতে পাথর জমতে বাধা দেয়ঃ
নিয়মিত জলপাই খেলে পিত্তথলির পিত্তরস ঠিকভাবে কাজ করে। পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
আয়রনের উৎসঃ
জলপাই বিশেষ করে কালো জলপাই আয়রনের উৎস, আয়রন আমাদের দেহে রক্ত চলাচল করাতে সহায়তা করে, আর প্রাকৃতিক আয়রনের উৎসের জন্য জলপাই-ই সেরা।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ঃ
জল পাইয়ে যে খাদ্যআঁশ আছে তা মানুষের দেহের পরিপাক ক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং হজমে সহায়তা করে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করেঃ
জলপাই রক্তের চিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ফলে ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
শীতকালের জনপ্রিয় ফল জলপাই
গবেষণায় দেখা গেছে, জলপাই অ্যালার্জি প্রতিরোধে সহায়তা করে। জলপাইয়ে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি যা ত্বকের ইনফেকশন ও অন্যান্য ক্ষত সারাতে কার্যকরী ভুমিকা রাখে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়ঃ
জলপাই প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে। সর্দি, জ্বর ইত্যাদি দূরে থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
হাড়ের ক্ষয়রোধ করে জলোপাই ফলঃ
জলপাইয়ের মনো স্যাচুরেটেড চর্বিতে থাকে প্রদাহবিরোধী উপাদান। বয়সের কারণে অনেকেরই হাড়ের ক্ষয় হয়। হাড়ের ক্ষয়রোধ করে জলপাই তেল।
ত্বক ও চুলের যত্নে জলোপাই ফলঃ
কালো জলপাইয়ের তেলে রয়েছে ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ত্বক ও চুলের যত্নে কাজ করে। জলপাইয়ের তেল চুলের গোড়ায় লাগালে চুলের গোড়া মজবুত হয়। এতে চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যা দূর হয়।
জলপাইয়ের ভিটামিন-ই ত্বকে মসৃণ ভাব আনে। এ ছাড়া ত্বকের ক্যানসারের হাত থেকেও বাঁচায় জলপাই। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির কারণে ত্বকের যে ক্ষতি হয় তা–ও রোধ করে জলপাই।
লেখক, প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা
চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া ও প্রথম আলো
0 Comments